রাজবাড়ী জেলার ভাষা ও সংস্কৃতি
রাজবাড়ী জেলা প্রাচীন ইতিহাস ধারণ করে আছে।পদ্মা, চন্দনা, হড়াই, গড়াইয়ের সমতলে পলল মাটির উর্বর ভূমিতে আবহমানকালের প্রাচীন ঐতিহ্যের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিদ্যমান রয়েছে।রাজবাড়ী জেলার মানুষের মধ্যে জীবন-যাপনে, খাদ্য, কাজকর্ম, চলাচল, বাসভূমি বৈচিত্র আছে। এ ছাড়া ভাবপ্রকাশ, ব্যবহার রীতি, আদানপ্রদান এবং ভাষা ব্যবহারেও অঞ্চলভিত্তিক বিশেষত্ব আছে। মূলত এগুলো তাদের শত শত বৎসরের লোকজ মানুষের মটিফের প্রকাশ। রাজবাড়ী জেলার ভৌগলিক অবস্থানে কুষ্টিয়া, যশোহর, ফরিদপুর, পাবনা ও মানিকগঞ্জ এর প্রভাবে প্রভাবিত। এসব জেলা থেকে কম বেশী মানুষের রাজবাড়ী জেলায় অভিবাসিত হলেও বেশী পরিমাণ অভিবাসন রয়েছে পাবনা জেলা থেকে। ষাটের দশকে কুমিল্লা, নোয়াখালী থেকেও কিছু পরিমাণ মানুষের অভিবাসন ঘটে রাজবাড়ী জেলায়। রাজবাড়ী ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গের এলাকা। বঙ্গ ছিল ভাটির দেশ। বঙ্গ বলতে সমতটীয় বর্তমান রাজবাড়ী, ফরিদপুর, যশোহরকে বোঝান হয়। বঙ্গের মানুষের সাধারণ জীবনচারিতা এরা সহজ সরল আড়ম্বরহীন জীবনে অভ্যস্ত। ইষ্টিকুটুম বাড়ীতে এলে সবাই আনন্দিত হয়। চাউলের রুটির সাথে মুরগীর গোস্ত, সে সাথে চিতাই পিঠা, প্রিয়। ধুপি পিঠা, কুশলীপিঠা তৈরী করে। ইলিশ, কৈ, মাগুর, শোল, বোয়াল এসব গ্রামীণ মানুষের প্রিয় খাবার। এককালে এলাকাটি হিন্দু প্রধান এলাকা ছিল। এখনও অনেক হিন্দু বসবাস করে। হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একে অপরের সাথে ভাব ভালবাসার অভাব নেই। মুসলমানদের বাড়ীর দাওয়াত হিন্দু খায়, হিন্দুর নিমন্ত্রণে মুসলমান তাদের বাড়ীতে যায়। মুসলমান একে অপরকে দেখলে সালাম এবং হিন্দু আদাব প্রদান করে। তবে সকলেই জীবনাচরণ একসাথে, এক মাঠে একঘাটে।
ভাষা ব্যবহারে রাজবাড়ীর মানুষের বিশেষত্ব রয়েছে। এরা ভাইকে বাই, উঠানকে উঠোন, কেমন করে অর্থ্যাৎ ক্যাম্বা, যেমনকে অর্থ্যাৎ য্যাম্বা, খাওয়াকে বলে খাবনে যাওয়াকে বলে যাবনে, যাওনা কেন বলবে যাসনে কেন, আসিসনে কেন, হওয়াকে বলে হয়া, যাওয়াকে বলে যাওয়া, বেগুনকে বলে বাগুন, লাউকে কদু, কুকুরকে কুত্তো, কুমড়াকে কুমড়ো, তেলেকে তেলো বলে। আবার পাবনার প্রভাবিত অনেকে ‘‘স’’ এর স্থলে ‘‘হ’’ উচ্চারণ করে যেমন সবকে হব, সুঁইকে হুই, সন্ধাকে হন্দে ভাষা ব্যবহার করে।
এরূপ নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির প্রবাহ রয়েছে রাজবাড়ী জেলায়। এ ভাষাতেই রচিত হয়েছে রাজবাড়ী জেলার লোকজ গান, খেলা, মেলাসহ জীবনের দৈনন্দিন বিষয়।
রাজবাড়ী জেলার দুই একটি আঞ্চলিক গানঃ
পদ্মার পাশে ছোট্ট শহর
মোদের রাজবাড়ী
হেথা দেশ-বিদেশে যাওয়ার জন্যে
আছে ও ভাই রেলের গাড়ী ।।
নিত্যি আসে ঝুরি ঝুরি
তাজা ইলিশ মাছ
মোদের খাওয়ার জন্যে পদ্মা
জোগায় বার মাস
আবার মাঝে মাঝে দুই এক হালি
পাঠাই ও ভাই কুটুম বাড়ী।।
দাদশী আছে খোদাই দরগাহ
খোদার রহমত পাই
আলাদীপুরে জামাই পাগলের
মাজার আছে ভাই
লক্ষীকোলে বিখ্যাত এক
ছিল ও ভাই রাজার বাড়ি।।
রকম রকম ফল-ফলালী
বাঙ্গী তরমুজ ভাই
গরমকালে আম কাঁঠালের
অভাব মোদের নাই
ফলে ভরা ফসলে ভরা
স্মৃতি ভরা রাজবাড়ী।
মোঃ ইদ্রিস মিয়া ময়না
প্রবাদ, প্রবচনঃ
১। ‘যে যায় পাবনা, তার নেই ভাবনা’
-যথা সম্ভব নীলচাষের সময় এলাকাটি অত্যাচারিত হওয়ায় পাবনাকে অপেক্ষাকৃত ভাল জায়গা মনে করে লোকে এ প্রবাদ তৈরী করেছিল।
২। ‘নামে খায় বেলগাছির গুড়’
বেলগাছির গুড়ের এক সময় খুব সুনাম ছিল। এ সুনাম আজও রয়েছে।
৩। ‘এ কয় টাকা লাভ পেলেই আমি বালেকান্দীর ঠাকুর’
অল্পতেই তুষ্ট-
প্রবচনঃ
১। মাথায় বোঝা কোদালে চাষ
যে বাঁচবে শত সে বাঁচে পঞ্চাশ।
২। গড্ডার মালো তোর গড়গড়াটা কই
হালের বলদ বাঘে খায়ছে
পিঁপড়ে টানে মই।
৩। অতি বড় হয়ো না ঝড়ে ভাঙে নেবে
অতি ছোট হইওনা ছাগলে মুড়ে খাবে।
৪। ভাবে মল কুরনের মা
আটের মানুষ শুবেন কনে?
৫। সব নদী খান খান
হড়াই নদী সাবধান।
‘‘ছড়া’’
১। গড়াই, হড়াই,চন্দনা
চলছে দেখ মন্দনা
চলত যখন চাঁদ সওদাগর
করত সবাই বন্দনা।
২। আসে গেছে রেলের গাড়ি
যাওয়ার নাই আর মানা ঢাকা, মেলে কুষ্টে যাব
তা না না না।
৩। ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা
বোয়াল মাছের দাড়ি
টিক্কা খান ভিক্ষা চায়
গোয়ালন্দের বাড়ি।
উৎসব অনুষ্ঠানঃ
গ্রাম্য মেলা, সার্কাস, সাপের খেলা, নাগর দোলা, পুতুল নাচ, পালা গান, লাঠি খেলা, নৌকা বাইচ, পুনাহ, নববর্ষ, হাল-খাতা, মহররম, দূর্গা পূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা, বিবাহ, খাৎনা, খাদ্য আনুষ্ঠানিকতা, ঈদ উৎসব এসব জাঁক জমকের সাথে রাজবাড়ীতে পালন করা হয়। এর মধ্যে মেলা, পার্বন, মহররম,ঈদ, বিবাহ, খাৎনা প্রধান উৎসব হিসাবে পালন করা হয়।
মানব সংস্কৃতির ধারায় উৎসব প্রকৃতির ধারা বিকশিত হয়েছে। ক্ষুধার্ত মানুষের খিটমিটে স্বভাব ক্ষুধা নিবৃত্তির পর বললে যায়। অর্থ্যাৎ আরাম আয়েস মানুষের আনন্দ উৎসব প্রকাশ করায়। এছাড়া ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানাদি উৎসব আনন্দে রূপ নেয়।
মেলার সাধারণ অর্থ সমাবেশ। আকাশে তারার মেলা অর্থ্যাৎ তারার সমাবেশ। তবে মেলার বৈশিষ্ঠ হলো তা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে স্থান বিশেষে নির্দিষ্ঠ সময়ের জন্য লোক সমাবেশ ঘটে। আমাদের মেলাগুলিকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ- (১) ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষ, রথ যাত্রা, ঝুলন, গাজন, চড়ক, দোল, নবমী, সপ্তমী, বারুনী, পৌষ পার্বন, বুদ্ধ পূর্ণিমা, মাঘি পূর্ণিমা, শিব রাত্রি, মহররম, শবে-ই-বরাত, ঈদ, ওরশ, দেবতা বা দরবেশের মেলা ইত্যাদি। (২) ধর্ম নিরপেক্ষ রাজবাড়ীতে বিভিন্ন লোকায়ত উৎসব নববর্ষ, কৃষি মেলা, ওরশ মেলা, ঘোড় দৌড়ের মেলা, বৃক্ষ মেলা, শিল্প মেলা ইত্যাদি রাজবাড়ীতে অনুষ্ঠিত কয়েকটি মেলার পরিচয়। লক্ষ্ণীকোল বুড়ির মেলা, লক্ষ্ণীকোল রাজা সূর্য কুমারের বাড়ী সংলগ্ন কয়েকশত বৎসরের পুরাতন প্রকান্ড বট গাছের নিচে ১ বৈশাখ থেকে ১ মাস ব্যাপী মেলা বসে। সাধারণ লোকে একে বুড়ির মেলা বলে। মেলাটি রাজা সূর্য কুমারের সময় অত্যান্ত জাঁকজমকের সাথে পালিত হতো। সে সময় লোকজ ও সংস্কৃতির সমাবেশ ঘটতো। তার পুত্র কুমার বাহাদুর সে ঐতিহ্য রক্ষা করে গেছেন। লক্ষ্ণীকোল রাজবাড়ীর স্মৃতি চিহ্ন নেই। তবে এখনও মেলা বসে কিন্তু মেলার সে আমেজ নেই।
রাজবাড়ী জেলায় প্রচলিত লোকনৃত্যঃ
ঢেঁকিনাচঃঢেঁকি বাংলার লোকজ সংস্কৃতির বাহন। ঢেঁকিতে ধানবানার সময় তালে তালে পা উঠানামা করে এবং শরীর দোলে। ঢেঁকির ছন্দের মত ছন্দ তুলে নাচ করা হয়। এ সাথে গানও করা হয়।
ও ধান বানিরে ঢেঁকিতে পা দিয়া
ঢেঁকি নাচে আমি নাচি দোলিয়া হেলিয়া দুলিয়া।
জারী নাচঃ রাজবাড়ী অঞ্চলে জারিগান বিশেষ ভাবে প্রচলিত। গ্রামের বিশেষ আর্কষন এই জারিগান। জারিগানের সাথে দলনেতাসহ সকলেই নেচে নেচে গান করে। গানের সাথে নাচের বিশিষ্ঠতা লক্ষ্য করা যায়।
সারিনাচঃ সারিনাচ নৌকা বাইচের নাচ। নৌকা বাইচের সময় সারিবদ্ধ ভাবে বাইচেরা নাচ করে।
ছোকরা নাচঃ রাজবাড়ি অষ্টক গানের প্রচলন আছে। এই অষ্ঠক গান সাধারণত ছেলে ছোকরাদের দ্বারা গাওয়ান হয়। এই ছেলেরা গানের সাথে নাচ করে।
কীর্তন নাচঃ রাজবাড়ি একসময় হিন্দু প্রধান ছিল। পূজাপর্বন ছাড়াও অন্য সময় কীর্তনের সাথে এ নাচ করে। রাজবাড়ি এবং অঞ্চল বিশেষ করে সোনাপুর সমাধিনগর এলাকায় এ নাচের প্রচলন রয়েছে।
বৃষ্টি নামানোর নাচঃ বৃষ্টি নামানোর জন্য এলাকায় মেয়েরা দল বেঁধে দেওয়ারে তুই অঝোরে অঝোরে নামো, দেওয়ারে বেহানে বেহানে নামো এ গানের সাথে নাচ করে।
লাঠি নাচঃ
রাজবাড়িতে লাঠি খেলা একটা প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খেলা । এখনও এলাকায় মেলা পর্বনকে ঘিরে লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়। এটি একটি ছন্দের খেলা, খেলার সাথে নাচের দৃশ্য ফুঠে ওঠে।
ঘেটুনাচঃ ঘেটুনাচ গ্রামীণ লোকজ কথা, সুর ও অতি সাধারণ ভাবে নাচ করে।
ও মোর সুন্দরী
ক্যান করেছ মন ভারি
আমি এনে দেব আলতা সাবান
আর করো মান ভারি
সুন্দরী ক্যান করেছ মন ভারি।
এ রকম গানের তালে নাচ করে।
রাজবাড়ী জেলার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের তালিকাঃ
ক্রমিক নং | সাংস্কৃতিক সংগঠনের নাম | প্রতিষ্ঠাকাল | কাযক্রম |
১ | উদীচি শিল্পী গোষ্ঠী, রাজবাড়ী | ১৯৮০ | গান, নাচ, আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদি |
২ | রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ | ১৯৯০ | বাংলা গান, আলোচনা সভা ইত্যাদি |
৩ | আবোল তাবোল শিশু সংগঠন | ১৯৯৪ | শিশুদের নাটক, গান, নৃত্য, আবৃত্তি, রক্ত সংগ্রহ, শীতার্ত ও বন্যার্তদের জন্য বস্ত্র সংগ্রহ ও প্রদান ইত্যাদি |
৪ | মুক্তি পাঠ চক্র | ২০০০ | বই নিয়ে আলোচনা, গবেষণা, বইমেলা, পুরোনো বইয়ের প্রদর্শনী ও বই উৎসব ইত্যাদি |
৫ | লক্ষিকোল লালন সংগঠন | ২০০৩ | আবৃত্তি, গান ও তবলা শিখানো ইত্যাদি |
৬ | রাজবাড়ী আবৃত্তি পরিষদ | ২০০৩ | আবৃত্তি চর্চার প্রসার ও প্রশিক্ষণ এবং আবৃত্তি বিষয়ক অনুষ্ঠান ও কর্মশালা ইত্যাদি |
৭ | মাতা-পিতা বাউল সংগীত শিক্ষালয় | ২০০৩ | লালনগীতি, আধ্যাত্মিক পালা গান, মুর্শিদী ও জারী-সারী ও হারমোনিয়াম, বেহালা, সারিন্দা, বাঁশি, মন্দিরা, ঢোলসহ বিভিন্ন যন্ত্রসংগীত তালিম প্রদান করা হয়। |
৮ | লালন বাউল সংগীত একাডেমী | ২০০৪ | ভাব বৈঠকী গান, লালরগীতি ও যন্ত্রসংগীত ইত্যাদি |
৯ | দোলনচাঁপা সংগীতাঙ্গন | ২০০৫ | উচ্চাঙ্গ সংগীত, নজরম্নল গীতি, রবীন্দ্র সংগীত ও অন্যান্য বাংলা গান এবং সংগীত কর্মশালা ইত্যাদি |
১০ | দর্পণ বাউল সংগীত স্মৃতি সংঘ | লালনগীতি, আধ্যাত্মিক পালা গান, মুর্শিদী ও জারী-সারী প্রভৃতি গানের চর্চা ও বিশেস্নষণ | |
১১ | প্রিয়তমাসু আবৃত্তি নিকেতন | ২০০৮ | শিশুদের উচ্চরণসহ আবৃত্তি প্রশিক্ষণ ও অনুষ্ঠান ইত্যাদি |
১২ | রাজবাড়ী জেলা বাউল পরিষদ | ২০০৯ | লালনগীতি, আধ্যাত্মিক পালা গান, মুর্শিদী ও জারী-সারী প্রভৃতি গানের চর্চা ওবিশ্লেষণ। |
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস